আধুনিক ক্রিকেটে আফগানিস্তানের দ্রুত উন্নতি সবার কাছে একটি প্রেরণার দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের উত্থান কেবল একটি চমৎকার কাহিনিই নয়, এটি কঠোর পরিশ্রম, দৃঢ় সংকল্প এবং সঠিক নেতৃত্বের উদাহরণও। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনে তারা একের পর এক রেকর্ড গড়ে দেখিয়েছে যে, ছোট দল হলেও বড় স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব। তাদের সাম্প্রতিক টেস্ট ক্রিকেট অর্জন এই ধারাবাহিক উন্নতিরই জ্বলন্ত প্রমাণ।
জিম্বাবুয়ে-আফগানিস্তান ম্যাচ। ছবি- আফগান ক্রিকেট
আফগানিস্তান টেস্ট ক্রিকেটে নতুন হলেও, তাদের পারফরম্যান্স চমকপ্রদ। সম্প্রতি, তারা মাত্র দশম টেস্টেই এক ইনিংসে ৬০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেছে, যা টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে কম ম্যাচে এই অর্জন। বাংলাদেশের জন্য এই রেকর্ড গড়তে লেগেছিল ৭৬টি ম্যাচ, আর নিউজিল্যান্ডের ক্ষেত্রে লেগেছিল রেকর্ড ২০৬টি ম্যাচ। এই অর্জন আফগানিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায় রচনা করেছে।
গতকাল জিম্বাবুয়ের বুলাওয়েতে আফগানিস্তান এবং জিম্বাবুয়ের মধ্যকার টেস্ট ম্যাচটি ড্র হয়েছে। যদিও ম্যাচটি নিষ্ফলা ছিল, তবে এটি রেকর্ড বইয়ে জায়গা করে নিয়েছে অন্য কারণে। এই ম্যাচে দুই দলই নিজেদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ গড়েছে। জিম্বাবুয়ে প্রথম ইনিংসে ৫৮৬ রান সংগ্রহ করে। এর পর আফগানিস্তান ৬৯৯ রান করে ইতিহাস গড়ে। এটি ছিল জিম্বাবুয়ের মাটিতে আফগানিস্তানের প্রথম টেস্ট, এবং এই ম্যাচে তাদের ব্যাটিং শক্তিমত্তার গভীরতা পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
আফগানিস্তানের বিশাল স্কোরের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছেন অধিনায়ক হাশমতউল্লাহ শহীদি এবং রহমত শাহ। তারা উভয়েই ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন, যা তাদের টেস্ট ক্যারিয়ারের অন্যতম স্মরণীয় মুহূর্ত। রহমত শাহর দারুণ ২৩৪ রান এবং শহীদির ২৪৬ রানের ইনিংস দলকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। পাশাপাশি, মিডল অর্ডারের ব্যাটসম্যান আফসার জাজাই ১১৩ রান করে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তাদের এই পারফরম্যান্স দলকে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এমন বড় স্কোর গড়তে সাহায্য করেছে।
আফগানিস্তান তাদের টেস্ট অভিষেক করে ২০১৮ সালে। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই তারা এমন একটি কৃতিত্ব অর্জন করেছে, যা পাকিস্তানের ৬৬ বছর পুরোনো রেকর্ডকে ভেঙে দিয়েছে। ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের টেস্ট অভিষেকের পর ১৯৫৮ সালে বার্বাডোজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৬০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেছিল। সেই ম্যাচে হানিফ মোহাম্মদের মহাকাব্যিক ৩৩৭ রানের ইনিংস আজও ক্রিকেটপ্রেমীদের স্মৃতিতে অমলিন।
বাংলাদেশের প্রথম ৬০০ রানের ইনিংস আসে ২০১৩ সালে, তাদের ৭৬তম টেস্টে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে গল টেস্টে বাংলাদেশ ৬৩৮ রান করেছিল। সেই ঐতিহাসিক ম্যাচটি স্মরণীয় হয়ে আছে মুশফিকুর রহিমের দেশের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির জন্য। মুশফিক ২০০ রান করেন, আর মোহাম্মদ আশরাফুল করেন ১৯০ রান। নাসির হোসেনও ১০০ রান যোগ করেন। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সেই ম্যাচটি আজও ভক্তদের হৃদয়ে জেগে আছে।
নিউজিল্যান্ডের ক্ষেত্রে প্রথমবার ৬০০ রান করতে লেগেছিল সবচেয়ে বেশি ম্যাচ—20৬টি। যদিও তারা বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম চক্রের শিরোপাজয়ী দল, তাদের টেস্ট ইতিহাসে দলীয় রেকর্ড গড়তে বেশ সময় লেগেছে। অন্যদিকে, দক্ষিণ আফ্রিকা সময়ের হিসেবে সবচেয়ে বেশি সময় নিয়ে ৬০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করে। তাদের এই কৃতিত্ব অর্জনে লেগেছিল ৭৭ বছর।
জিম্বাবুয়ে এবং আয়ারল্যান্ড এখনও টেস্টে ৬০০ রান করতে পারেনি। জিম্বাবুয়ের সর্বোচ্চ সংগ্রহ ৫৯৫ রান, যা তারা ২০০৫ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে করেছিল। আয়ারল্যান্ডের সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ ৪৯২ রান। টেস্ট ক্রিকেটে নবীন দল হিসেবে তাদের এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।
আফগানিস্তানের ৬০০ রানের এই রেকর্ড কেবল একটি সংখ্যার বিষয় নয়; এটি তাদের কঠোর পরিশ্রম, সামর্থ্য এবং ক্রিকেটের প্রতি আবেগের প্রতিফলন। দ্রুত উন্নতির এই ধারা যদি অব্যাহত থাকে, তবে বিশ্ব ক্রিকেটে তাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে। ইতিহাস গড়ে তারা প্রমাণ করেছে, সঠিক পরিকল্পনা এবং একাগ্রতা থাকলে ছোট দলগুলোও বড় কিছু করতে পারে।
আফগানিস্তানের টেস্ট ক্রিকেটে এমন দ্রুত উন্নতি তাদের ভবিষ্যতের উজ্জ্বল সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। রহমত শাহ, হাশমতউল্লাহ শহীদি, এবং রশিদ খানের মতো খেলোয়াড়রা আফগান ক্রিকেটকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন। তাদের দশম টেস্টেই ৬০০ রানের মাইলফলক অর্জন করা প্রমাণ করে যে, আফগানিস্তান শুধুমাত্র সীমিত ওভারের ক্রিকেটেই নয়, বরং টেস্ট ক্রিকেটেও এক শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে।
এই কৃতিত্ব আফগান ক্রিকেটের জন্য এক বিরাট প্রেরণা। এত কম সময়ে এত বড় অর্জন তাদের ভবিষ্যতের জন্য এক মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। তাদের পারফরম্যান্স দেখিয়ে দিচ্ছে, ক্রিকেটের প্রতি তাদের একাগ্রতা এবং ভালোবাসা কতটা গভীর। এ ধরনের অর্জন নতুন প্রজন্মের খেলোয়াড়দের জন্য উদাহরণ হিসেবে কাজ করবে এবং তাদের অনুপ্রেরণা জোগাবে।
আফগানিস্তানের উত্থানের পেছনে রয়েছে এক দীর্ঘ পরিশ্রমের গল্প। তাদের ক্রিকেটের শিকড় গড়ে উঠেছে এক কঠিন বাস্তবতায়। ২০০১ সালে আইসিসি সহযোগী সদস্য হওয়ার পর থেকে তারা ধীরে ধীরে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা এক সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু তারা দেখিয়েছে, ইচ্ছাশক্তি এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সবকিছুই সম্ভব।
টেস্ট ক্রিকেটে আফগানিস্তানের এমন অর্জন তাদের জন্য একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। বিশ্বের বড় বড় দলগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করা তাদের জন্য এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের মতে, আফগানিস্তানের এই উত্থান বিশ্ব ক্রিকেটের জন্য একটি ইতিবাচক বার্তা বহন করে। এটি দেখায় যে, সঠিক পরিকল্পনা, ভালো নেতৃত্ব এবং প্রতিভার বিকাশের সুযোগ থাকলে যে কোনো দল বড় কিছু অর্জন করতে পারে।
আফগানিস্তানের ক্রিকেটে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন তাদের খেলোয়াড়েরা। রহমত শাহ, হাশমতউল্লাহ শহীদি, রশিদ খান, মোহাম্মদ নবীর মতো খেলোয়াড়রা তাদের দলের সাফল্যে প্রতিনিয়ত অবদান রেখে চলেছেন। বিশেষ করে রশিদ খান, যিনি শুধু টেস্টেই নয়, সীমিত ওভারের ক্রিকেটেও নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। তার বোলিং দক্ষতা এবং নেতৃত্বগুণ দলকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
আফগানিস্তানের ব্যাটিং লাইনআপ এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। হাশমতউল্লাহ শহীদি এবং রহমত শাহর মতো খেলোয়াড়রা দেখিয়েছেন, তারা বড় ম্যাচে বড় ইনিংস খেলতে সক্ষম। একইভাবে, তাদের বোলিং আক্রমণও অত্যন্ত শক্তিশালী। রশিদ খান, মুজিব উর রহমান এবং অন্যান্য বোলাররা দারুণভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাদের বোলিং আক্রমণ প্রতিপক্ষের জন্য প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
বিশ্ব ক্রিকেটে আফগানিস্তানের অবস্থান এখন শক্তিশালী। টেস্ট ক্রিকেটে তাদের এমন অর্জন প্রমাণ করে যে, তারা শুধু অংশগ্রহণ করার জন্য নয়, জয়ী হওয়ার জন্য মাঠে নামছে। তাদের বর্তমান ফর্ম ধরে রাখতে পারলে তারা ভবিষ্যতে আরও বড় রেকর্ড গড়তে সক্ষম হবে। আফগানিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাসের এই অধ্যায় একদিন বিশ্ব ক্রিকেটে তাদের স্থায়ী অবস্থান নিশ্চিত করবে।